স্বপ্ন পরীর লাল জামা

Tareq Aziz

চারদিকে শুনশান নিরবতা। ঝিঝিপোকার শব্দে পরিবেশ হয়ে আছে এক অন্য রকম। জলিল মিয়া ঢাকা যাবে রাতের বাসে। বাড়ি থেকে বের হতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। গ্রামগঞ্জে রাত ৮:৩০ মিনিট সময়টা অনেক গভীর রাত বলা যায়। কারণ সন্ধ্যার পরেই গ্রামে নেমে আসে ঘন ঘুটঘুটে অন্ধকার। জলিল মিয়ার কোন রকম খেয়ে দেয়ে দিন কাটে কাচা টিনের ছাউনির ঘরে। তাদের একমাত্র মেয়ে দেখতে পরীর মতো, তাই আদর করে নাম রেখেছে পরী।

মেয়ের বায়নাঃ বাবা এইবার ঈদে শহর থেইকা আসার সময় আমার জন্য একটা সুন্দর লাল জামা আনবা। লাল জামা পইরা আমি সবার সাথে ঈদে যাবো।
ঠিক আছে মা, আনমু। আমার পরীর জন্য লাল টুকটুকে জামা আনমু। আমার পরীকে দেখতে লাল পরীর লাহান লাগবো।

পরীকে তার বাবা কোলে তুলে নিলো আর কপালে আদর করে চুমু দিলো।
জলিল মিয়ার স্ত্রীঃ ওগো সাবধানে জাইয়ো আর জাইয়া একটা ফোন দিও।

অনেক জল্পনা কল্পনা শেষে জলিল মিয়া ঢাকা আসলো। এর পর প্রায় ২২ দিন কেটে গেলো। প্রতিদিনের মতো আজও পথের ধারে ভ্যানে করে ফল বিক্রি করছে জলিল মিয়া। কোনদিন ভালো বিক্রি হচ্ছে কোন দিন তেমন হচ্ছে না। একদিন বাজারে পুলিশরা তল্লাশি চালাচ্ছে কার্বোহাইড্রেট মিশ্রিত ফল যা পাচ্ছে তা নষ্ট করে ফেলছে। জলিল মিয়ার বুক ধরফর করছে। তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, একটুপর তার ফলগুলোও ধরবে। চোখে অশ্রু গড়াবে। তাই হলো, পুলিশ তার সব ফল নষ্ট করে দিলো।

জলিল মিয়া মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে কাঁদছে আর কাঁদো কন্ঠে বলছে, তার শেষ সম্বল পুঁজিটাও শেষ। হাতে কোন টাকা নেই, যা ছিলো পুলিশ জরিমানা হিসেবে নিয়ে গেলো। অনেক আকুতি মিনতি করলো, তবুও তাদের পাষাণ হৃদয়ে তার আকুতি মিনতি ছিটেফোঁটাও বিঁধলোনা।

প্রায় ১৫ মিনিট পর বাড়ি থেকে ফোন এলো।
জলিল মিয়াঃ বুকে কান্না চেপে বলছে,
হ্যালো!
ওপাশ থেকে তার মেয়েঃ বাবা, কিরাম আচো?
জলিল মিয়াঃ (চাপা কান্নায়) হ্যা, মা ভালো, তুই কেমন আছিস মা!
মেয়েঃ ভালো না বাবা, তুমি আমার লাল জামা কবে আনবা। আমি লাল জামা পরবো, ওদের সাথে ঘুরবো। জানো বাবা! ওরা অনেকে জামা কিনচে কি সুন্দর সুন্দর! আমারে দেখাইচে, আমিও ওগোরে বলছি, আমার বাবাও আমার জন্য খুব সুন্দর লাল জামা আনবো।
জলিল মিয়াঃ কি বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা (চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে অবিরাম) চোখ মুচ্ছে আর বলছে, ঠিক আছে মা, আমি আহনের সময় তোর জামা নিয়া আসমু।
মেয়েঃ ঠিক আছে বাবা, তুমি তাড়াতাড়ি আইসো।
মেয়ের মাঃ দে আমারে দে আমি একটু কথা কই, হ্যালো।
জলিল মিয়াঃ টুট টুট (বলার আগেই কেটে দিলো)
কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা, সময়টাও ঘনিয়ে এলো। ভেবেছিলো শহর থেকে কেনাকাটা করেই বাড়ি যাবে। সবাইকে নিয়ে একসাথে ঈদ করবে আর সেমাই-চিনি দিয়ে সবাইকে নিয়ে মিষ্টি মুখ করবে।

ঈদের আর মাত্র দু’দিন বাকি! জলিল মিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। কোন রকম খেয়ে দেয়ে বেঁচে আছে, কেনাকাটা করার মতো পকেটে কড়ি টাকাও নেই। তার চিন্তা মেয়ের জন্য লাল জামা নিতে হবে।
ওদিকে ফোন এলো বাড়ি থেকে।
জলিল মিয়ার স্ত্রীঃ হ্যালো, কবে আইবা? মেয়েটা তোমার অপেক্ষায় খাওয়া দাওয়াও ঠিক মতো করেনা, রাতে ঘুমায়ও না। শুধু বলে আজ বাবা আইবো। এই নাও কথা কও।
জলিল মিয়াঃ হ্যালো,পরী মা।
মেয়েঃ বাবা ঈদের তো আর ২ দিন বাকি তুমি কবে আইবা?
জলিল মিয়াঃ এই তো মা কালই চইলা আসমু।
মেয়েঃ আমার জন্য লাল জামা কিনচো?
জলিল মিয়াঃ হ্যা, মা! খুব সুন্দর জামা, আমার পরী মা কে লাল পরীর মতো লাইগবো। এখন রাখি মা, বাবা একটু ব্যস্ত আছি!
মেয়েঃ ঠিক আছে বাবা (মেয়ে তো খুশিতে আত্মহারা, বাবা আগামীকাল জামা নিয়ে আসবে)।

অন্যদিকে,
জলিল মিয়াঃ মেয়েকে তো বলছি কিন্ত এহনো তো কিছুই কিনি নাই। কিনবোই বা কি দিয়া একটা কড়িও নেই সাথে!
জলিল মিয়া কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। রাস্তার পাশ ধরে হাটছে। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখতে পেলো, এক যায়গায় ঈদের পোশাক বিতরণ করা হচ্ছে। সে ভাবছে যাবে নাকি যাবেনা। অন্য দিকে মেয়ের জন্য লাল জামা নিতে হবে। (সেখানে অনেক মানুষের ভিড়)

একটু পর দেখলো হইচই লেগে গেছে।
জলিল মিয়া ফিরে আসলো সেখান থেকে। ঈদের আর একদিন বাকি চুপচাপ বসে আছে জলিল মিয়া। জলিল মিয়ার এক বন্ধু (একসাথে থাকে বস্তিতে) বলছে, কিরে ঈদে বাড়ি যাবি না! বইসা আচিস ক্যান?
জলিল চুপচাপ কিছুই বলছেনা।
বন্ধুঃ কিরে কতা কস না ক্যা?
জলিল মিয়াঃ আকরাম সবই তো জানস, আবার জিগাস ক্যা!
বন্ধুঃ তাই বলে, এভাবে বইসা থাকবি? তোর মেয়ের জন্য জামা নিবিনা!
জলিল মিয়াঃ কি করুম, ভাইবা পাচ্ছিনা।
বন্ধুঃ এই নে ধর, ৩০০ টাকা। অন্ততপক্ষে মেয়ের জন্য একটা জামা নিয়া যা। আমার তো কেউ নাই, একলা থাহি, খাই আর ঘুমাই। যা তাড়াতাড়ি যা, পরে একসময় টাকা দিয়া দিস।
জলিল মিয়ার মুখে খুশির রেশ। দ্রুত চলে গেলো গুলিস্তান। তারপর সুন্দর থেকে দেখে মেয়ের জন্য একটা লাল জামা কিনলো। সে এখন খুব খুশি। কিছু সেমাই, চিনিও কিনলো। সাথে সাথে বাড়িতে ফোন করলো। জলিল মিয়ার স্ত্রী ফোন ধরলো।
জলিল মিয়াঃ হ্যালো, পরীর মা। আমি আইতাছি, সন্ধ্যায় বাসে উঠমু, পরী কই?
স্ত্রীঃ পরী খেলতে গেছে।
জলিল মিয়াঃ ওরে বইলা দিও ওর জন্য একটা লাল জামা কিনচি। ঠিক আছে এখন রাখছি।

জলিল জামা কাপড় গুছিয়ে রওয়ানা দিলো। সন্ধ্যার পর বাসে উঠলো। যেতে যেতে রাত ২ টা বাজবে। পরদিন ঈদ।
শত কষ্টের মাঝেও তার মুখে হাসি।
মেয়ের জন্য জামা কিনেছে মেয়ে খুব খুশি হবে। রাত প্রায় একটা ১:০০ বাজে। সবাই ক্লান্ত শরীরে ঘুমাচ্ছে। হঠাতৎ বাস থেমে গেলো। ঝাঁকুনিতে সবাই জেগে গেলো। হেল্পার নিচে নেমে দেখার আগেই, একদল মুখোশদারি ডাকাত এসে ঢুকে পড়লো বাসে, সবাই ভয়ে কাপতেছে।
ডাকাত সরদারঃ সবাই চুপচাপ বসে থাকো। কেউ কোন নড়াচড়া করবানা। নড়াচড়া করলে একদম গুলি করে দিবো। যা বলি তাই করো, যার কাছে যা আছে বের করো। যার কাছে যা আছে বের করে সামনে রাখলো। দুইজন ডাকাত সব কিছু নিয়ে তাদের ব্যাগে নিলো।
একজন মহিলা দিতে চাচ্ছেনা, তাকে থাপ্পর মেরে জোর করে নিয়ে গেলো।
এর পর জলিল মিয়ার কাছে এলো, সে তার ব্যাগটা দিতে চাচ্ছেনা। অনেক টানাটানি করলো, তাকেও থাপ্পর মারলো, লাথি মারলো তবুও সে দিচ্ছেনা। সে কান্না জড়িত কন্ঠে বলেঃ ভাই এইহানে কিচু নাই ভাই, ভাই, শুধু আমার মাইয়ার লাইগা একটা জামা কিনছি ভাই। মাইয়া বড়ো শখ করছে ভাই। জলিলের আহাজারি, কে শুনে কার কথা, জোর করে নিয়ে গেলো। যখন সে উঠে পিছে পিছে যাবে, তখন সাথে সাথেই তাকে গুলি করে দিলো। বাকিরা সবাই ভয়ে নিস্তব্ধ। একটা লোক উঠে দাঁড়াবে তাকেও গুলি করে দিলো।

ডাকাত সরদারঃ কেউ যদি একটু নড়াচড়া করে সোজা উপরে পাঠিয়ে দিবো। সবাই ভয়ে নিশ্চুপ, কাঁদতেছে খুব। ডাকাতরা চলে গেলো, জলিল মিয়ার নিথর দেহ পড়ে রইলো বাসের মেঝেতে।

তার লাশটাকে রাস্তার পাশে রেখে বাসটা চলে গেলো। অন্যদিকে জলিল মিয়ার বাড়ি থেকে ফোন করলো। ফোন বাজছে আর বাজছে কেউ ধরছেনা। মেয়ের অপেক্ষা, বাবা লাল জামা নিয়ে আসবে। সকাল হয়ে গেলো মেয়ে আবার ফোন দিলো, কেউ ফোন ধরছেনা। মা এবং মেয়ে দুজনেই খুব চিন্তা করছে। মেয়ে কাঁদছে আর বলছে, মা, বাবা আমার লাইগা জামা আনবোনা! মা, বাবা আহেনা ক্যান?

আবার ফোন দিল, কেউ একজন রিসিভ করলো ফোন।
মেয়েঃ হ্যালো বাবা! কই তুমি! আমার জামা কই, আইবা না তুমি, জামা আনবা না আমার লাইগা!
ওপাশ থেকেঃ তোমার আম্মু কোথায়? এইতো আছে, মা, মা, ওমা, এই লও কথা কও, কেডা জানি ফোন করছে।

জলিল মিয়ার স্ত্রীঃ হ্যালো!

ভদ্রলোকঃ হ্যালো, শুনুন। এখানে একটা লোক পড়ে আছে। উনার পাশে এই ফোনটা পেলাম। গতকাল রাতে কারা যেন উনাকে মেরে ফেলে গেছে।

জলিল মিয়ার স্ত্রীর আহাজারিঃ ও আল্লাহ গো, আমার সব শেষ হয়ে গেলো গো, ও পরীরে, তোর বাপতো আর নাইরে! পরীর মায়ের সাথে পরীও কাঁদে!

ভদ্রলোকঃ এই যে শুনুন, প্লিজ শুনুন! আপনি কোথায় থাকেন, ঠিকানা বলেন আমরা উনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।

দীর্ঘক্ষণ পরে জলিল মিয়ার লাশটা ভ্যানে করে তার বাড়ির দরজায় আনা হলো। জলিল মিয়ার স্ত্রীর আহাজারি! গ্রামের সব মানুষ জড়ো হতে লাগলো। লাশের পাশে জলিল মিয়ার স্ত্রী ও তার মেয়ে বসে কাঁদছে।

মেয়েঃ বাবা! ও বাবা, ওঠো বাবা! আমারে লাল জামা দিবানা! আমার লাল জামা কই বাবা! বাবা! কথা কওনা ক্যান বাবা! বাবা, তুমি না কইচো আমারে লাল পরী সাজাইবা! (মেয়ের কান্না জড়িত কন্ঠে আকাশটা ভারি হয়ে আসছে, সামনে উপস্থিত সবাই কাঁদছে)

বাবা, আমার জামা লাগবোনা, বাবা, তুমি আমারে আদর করবানা বাবা!

কাঁদতে কাঁদতে পরী বলতে লাগলো, ওঠো বাবা, আমার লাল জামা চাইনা বাবা। ওঠো বাবা, বাবা (বাবার বুকের উপর মাথা রেখে কাঁদছে পরী)।

এভাবেই হাজারো পরীর স্বপ্ন ভেঙে দুঃস্বপ্নই রয়ে যায়! কিভাবে যে তাদের ঈদ কাটে,! অশ্রু সিক্ত নয়নে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না! কে দিবে তাদেরকে সান্তনা, কে শুনবে তাদের আহাজারি!

লেখকঃ তাহছিন আহমেদ, মানবাধিকার কর্মী।

এই বিভাগের আরও সংবাদ

সম্পাদক ও প্রকাশক: মুহাম্মদ আমীরুল হক পারভেজ চৌধুরী

সম্পাদকীয় কার্যালয়ঃ
এডুএইড ৪র্থ তলা ৭৮ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা ১০০০
ইমেইল : eduaid21@gmail.com

© কপিরাইট এডুএইড ২০২৪।   ওয়েবসাইট নির্মানেঃ Contriver IT

সর্বশেষঃ