আমরা আমাদের লক্ষ্যের সমান বড়

Tareq Aziz

মার্কিন প্রতিষ্ঠান ইমারসন কালেকটিভ কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, এর নিরীক্ষা ও শিক্ষার্থীদের প্রণোদনা নিয়ে। এর প্রতিষ্ঠাতা লরেন পওয়েল জবস। ধনাঢ্য এই মার্কিন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা প্রয়াত প্রযুক্তিবিদ স্টিভ জবসের স্ত্রী। গত মে মাসে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন লরেন।

১৯৮৫ সালে আমি যখন পেনসিলভানিয়া (সংক্ষেপে পেন নামে পরিচিত) থেকে সমাবর্তন পেয়ে বের হই, ভীষণ ভয়ে ছিলাম। কী হবে, সামনে কী অপেক্ষা করছে আমার জন্য—এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। যদিও এখনকার বাস্তবতা আমার সময়ের চেয়েও বেশি গুরুতর, কিন্তু আমার ভয়গুলো তোমাদের চেয়ে আলাদা ছিল না। আমি একেবারে তোমাদের মতোই ছিলাম—মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা, ছুটির সময় খণ্ডকালীন চাকরি করা, সারাক্ষণ ব্রুস স্প্রিংস্টিনের গান শোনা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে।

মা হাইস্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন। আমার বয়স যখন তিন বছর, তখন বাবাকে হারাই। বাবা বিমানবাহিনীর পাইলট ছিলেন। একদিন অন্য বৈমানিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় মাঝ–আকাশে বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মারা যান। ওই সময় আমার মায়ের বয়স ৩০ বছর।

আমাদের চার ভাইবোনের বয়সই ছিল ছয়ের নিচে। এরপরও এত সব সংকট, সংগ্রাম, অনিশ্চয়তা মায়ের ব্যক্তিত্বে কোনো ছাপ ফেলেনি। তিনি আমাদের ভাইবোনদের কাছে হয়ে উঠেছেন সহিষ্ণুতার আদর্শ। তাঁর মতো সাহসী ও দৃঢ় মনোবলের মানুষ আমরা আর দ্বিতীয়টি দেখিনি।

উদ্যোক্তা হওয়ার জেদঃ
মায়ের দৃঢ়তার বৈশিষ্ট্য কিছুটা আমিও পেয়েছি। পেন-এ পড়ার জন্য আমাকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পয়সা জোগাড় করতে হয়েছিল। বেশ কয়েকটা বৃত্তি পেয়েছিলাম, শিক্ষাঋণ নিয়েছিলাম, তাতেও হয়নি। পরে ছুটির দিনগুলোয় স্মোকি জোনস নামের দোকানে ওয়েটারের কাজ করে খরচ সামলাতে হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন পেন স্টুডেন্ট এজেন্সিতে অভ্যর্থনাকারী হিসেবে খণ্ডকালীন চাকরিও করেছি ওই সময়ে।

এ চাকরি করতে করতেই আমি নতুন একটি সংগঠন চালু করার প্রস্তাব দিই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। ‘প্যারেন্ট সার্ভিসেস’ নামের সেই সংগঠন চালু করার অনুমতিও পেয়ে যাই। সংগঠনটির কাজ ছিল বিশেষ দিনে ও উপলক্ষে পরিবারের পক্ষ হয়ে আবাসিক শিক্ষার্থীদের কাছে প্রিয়জনদের পাঠানো ‘কেয়ার প্যাকেজ’ ও জন্মদিনের কেক পৌঁছে দেওয়া। এ উদ্যোগের কথা সবাইকে জানানোর জন্য আমরা একটা বুদ্ধি করলাম।

এক রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের বাড়ির বাইরে তাঁর নামে একটা কেক রেখে এলাম। ভেবেছিলাম, তিনি খুশি হবেন এবং আমাদের সংগঠনের প্রচার করবেন। কিন্তু পরদিন সকালে আমাদের কাছে এল পুলিশ! জানতে পারলাম, আমরা ভুল করে কেকটা এমন জায়গায় রেখে এসেছিলাম, যেখান থেকে ওটা প্রেসিডেন্টের বাড়ির কুকুর খেয়ে নিয়েছে এবং বেশি কেক খেয়ে ফেলায় সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমাদের উদ্যোগের নাম ছড়ানোর বদলে ঘটল বিপত্তি। কিন্তু ওই উদ্যোগ জলে গেলেও সেই ব্যর্থতার পর থেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার জেদ আমাকে পেয়ে বসে।

সহিষ্ণু হওঃ
তোমাদের এ গল্প বলার কারণ আছে। আমি হয়তো বুঝব না মহামারিকালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে কর্মজীবনে ঢোকার প্রতিকূলতাগুলো। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ব্যর্থতার আড়ালেও সম্ভাবনা আর রোমাঞ্চ লুকিয়ে থাকে। বর্তমানের মতো এমন অনিশ্চিত সময়ে তোমাদের মনে হতেই পারে যে পুরো পৃথিবী বুঝি যোগসাজশ করে তোমাদের ভবিষ্যৎকে কঠিন করে তুলছে, সম্ভাবনার পথকে সংকুচিত করে দিচ্ছে। আমি বলছি, এমনটা মোটেও ভেবো না। তোমরা সহিষ্ণু হও।

আমরা আমাদের লক্ষ্যের সমান বড়। আমরা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে নিজেদের লক্ষ্যকে বিস্তৃত করি। কিন্তু লক্ষ্যকে সুদূরপ্রসারী করা আর নিজেকে সে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা আমাদের আজীবন করে যেতে হয়।

আমার নিজের উদাহরণটাই দেওয়া যাক। যেদিন থেকে ভাবতে শুরু করলাম, আমি কীভাবে আরেকজনের উপকার করতে পারি, সেদিন থেকেই আমি নিজের ভেতর পরিবর্তন অনুভব করলাম। নিজের বদলে যাওয়া আর পৃথিবীর বদলে যাওয়ার মধ্যে অদ্ভুত মিল আছে। একটু একটু করে বদলাতে বদলাতে একদিন দেখা যায় অনেক কিছু বদলে গেছে। তাই নিজেকে সেই বদলের জন্য সব সময় প্রস্তুত রাখতে হয়।

উদ্যোক্তা হওয়ার পথে
গ্র্যাজুয়েশনের পর আমি আমার উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন পূরণে নেমে পড়ি। টেরাভেরা নামে অর্গানিক খাদ্যপণ্যের কোম্পানি চালু করি। ৩০ বছর আগের কথা বলছি। ওই সময় এ ধরনের কোম্পানির পরিকল্পনা ছিল একেবারেই নতুন।

কিন্তু আমি আমার উদ্যোগের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। কয়েক বছরের মধ্যে টেরাভেরা পুরো উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় সাড়া ফেলে দিল। বড় বড় ট্রাকে করে প্রতিদিন আমরা খাবার সরবরাহ করতে শুরু করলাম। এরপর এই উদ্যোগের সাফল্যের জের ধরেই আরও একটি কোম্পানি শুরু করলাম—কলেজ ট্র্যাক। সেখানেও সফলতা পাই। আর সবশেষে তৈরি করি ইমারসন কালেকটিভ। প্রতিটি উদ্যোগ দিয়েই আমি চেষ্টা করেছি মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে, ঠিক যেমনটা পেন থেকে বেরোনোর সময় ভেবেছিলাম।

কাজ করো ভালোবেসেঃ
১০ বছর আগে আমার স্বামী স্টিভ জবস আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে যান। তাঁকে হারিয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে আমি উপলব্ধি করলাম, আমরা কখনো কোনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারি না। বরং শোককে জীবনের অন্য অনুভূতিগুলোর সঙ্গে জুড়ে আরও পরিণত হয়ে উঠি।

স্টিভ_বলতেন, ‘কাজই আমাদের জীবনের বেশির ভাগ জায়গা দখল করে রাখবে। তাই জীবনে আত্মতৃপ্তি পাওয়ার একমাত্র পথ হলো বেশি করে ভালো কাজ করা। আর কাজ তখনই ভালো হবে, যখন আমরা তা ভালোবেসে করব।’ আশা করি, স্টিভের এই কথাগুলো তোমাদের পথ দেখাবে, যেভাবে আমাকে দেখিয়েছে। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুদিত

সূত্র: ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার প্রেস বিজ্ঞপ্তি

সূত্র: প্রথম আলো

এই বিভাগের আরও সংবাদ

সম্পাদক ও প্রকাশক: মুহাম্মদ আমীরুল হক পারভেজ চৌধুরী

সম্পাদকীয় কার্যালয়ঃ
এডুএইড ৪র্থ তলা ৭৮ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা ১০০০
ইমেইল : eduaid21@gmail.com

© কপিরাইট এডুএইড ২০২৪।   ওয়েবসাইট নির্মানেঃ Contriver IT

সর্বশেষঃ