► শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে
► অনলাইনে নামে মাত্র পড়ালেখা
► বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই পড়ালেখার বাইরে
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে করোনা শনাক্তের হার কমলে স্কুল-কলেজ ৩১ মার্চ খোলার তারিখ ঘোষণা করেছিল সরকার। কিন্তু আবারও শনাক্তের হার বাড়তে থাকায় আগের ঘোষণা থেকে সরে আগামী ২৩ মে স্কুল-কলেজ এবং ২৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সপ্তাহ দুয়েক ধরে শনাক্তের হার প্রতিদিনই বাড়ছে। ফলে আগামী মে মাসেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে কি না, সে অনিশ্চয়তাও দেখা দিচ্ছে। এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি পড়েছে শিক্ষাব্যবস্থা।
গত বছরের ১৭ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পর থেকেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ক্লাস সংসদ টেলিভিশনে প্রচার শুরু হয়; যদিও সেসব ক্লাস শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। শহরের নামি-দামি কিছু স্কুল অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে, তবে মফস্বল ও শহরের নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা এখনো পড়ালেখার বাইরে রয়েছে। ফলে গ্রাম ও শহরের শিক্ষার্থী এবং ধনী ও দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।
গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে দূরশিক্ষণে (সংসদ টিভি, অনলাইন, রেডিও ও মোবাইল ফোন) ৩১.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। অর্থাৎ ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো ধরনের অনলাইন শিক্ষার আওতায় আসেনি। যেসব শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণ প্রক্রিয়ার বাইরে রয়েছে তাদের মধ্যে ৫৭.৯ শতাংশ ডিভাইসের অভাবে অংশ নিতে পারছে না। আর গ্রামীণ এলাকায় এই হার ৬৮.৯ শতাংশ।
রাজধানী ও জেলা সদরের বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো অনলাইনে ক্লাস নিলেও সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখছে তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ৪০ মিনিটের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের যুক্ত হতে হতেই অনেকটা সময় চলে যায়। এরপর রোল নাম্বার ডাকা ও পড়া শুরু করতে করতেই সময় শেষ হয়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনলাইনে নামে মাত্র পড়ালেখা হচ্ছে। অনেক স্কুল অনলাইনে পরীক্ষাও নিচ্ছে। তবে সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষার আগে খুবই সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন বা হুবহু প্রশ্নই দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা পড়ে পরীক্ষা দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। আর প্রশ্নগুলোও দেওয়া হচ্ছে সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন, এককথায় উত্তর বা শূন্যস্থান পূরণ ধরনের। ফলে শিক্ষার্থীরাও পুরো বই পড়ছে না। এতে তারা প্রয়োজনীয় শিখনফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জি এম নিজাম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কভিডের এই পরিস্থিতিতে আমাদের কারো বাস্তবতার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে কোনো ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া আমাদের স্কুল, শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা যেভাবে অনলাইন ক্লাস করছে, সেটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। অবশ্য অনলাইন ক্লাসগুলোতে স্কুল টু স্কুল, টিচার টু টিচারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আবার অনেক শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস ঠিকমতো ধরতে পারে না। এর পরও যেসব শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস করতে পারছে, তারা যতটুকুই হোক পড়ালেখার মধ্যে রয়েছে।’
গত শিক্ষাবর্ষে যেহেতু শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করতে পারেনি, তাই সবার আশা ছিল চলতি শিক্ষাবর্ষে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত চলতি বছরের তিন মাস পার হলেও শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারেনি। আর বর্তমানে করোনার যে অবস্থা, তাতে কবে তারা স্কুলে যেতে পারবে তা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
করোনার কারণে গত বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেটসহ (জেএসসি) স্কুলগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি ও সমমান এবং ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। অথচ এই শিক্ষার্থীদের এখনো প্রয়োজনীয় পড়ালেখাই শেষ হয়নি। সম্প্রতি করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় তাদের পরীক্ষা কবে নেওয়া হবে সেটা পুরোপুরিই অনিশ্চিত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এতে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি পড়েছে শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, ‘এই মুহূর্তে করোনার যে পরিস্থিতি তাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা খুবই কঠিন। কিন্তু পরীক্ষা ছাড়া পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত করার পক্ষেও আমি নই। এ জন্য অনলাইন ক্লাসকেই আরো আধুনিক করতে হবে। বিশেষ করে গুগল ক্লাসরুমের মতো আরো কিছু সফটওয়্যার কিন্তু অনেকটা ক্লাসের মতোই। তবে এখানে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—গ্রামের শিক্ষার্থীদের ডিভাইস নেই, ইলেকট্রিসিটি ও ইন্টারনেট সমস্যা। এখন কবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে তা আমরা বলতে পারছি না। তাই এ চ্যালেঞ্জগুলো কিভাবে সমাধান করা যায় সে ব্যাপারে সরকারকে বড় উদ্যোগ নিতে হবে।’
সুত্রঃ কালেরকন্ঠ