মানুষের আস্থা যখন টেলিমেডিসিনে

শিপন মীরঃ

খালেদা আক্তারের বয়স ২৯ বছর। রংপুর জেলা সদরে একটি কলেজে শিক্ষকতা করছেন। গেল দুদিন ধরে কয়েক দফায় বেড়েছে শরীরের তাপমাত্রা । ১০৪ ডিগ্রি জ্বরের সঙ্গে আবার হালকা কাশি ও মাথাব্যথা। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ চিন্তিত খালেদার স্বজনদের। ঘর থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার শক্তিটুকু নেই। কোভিড-১৯ এর লক্ষণ বিদ্যমান থাকায় তাঁর ধারণা সে করোনা আক্রান্ত। কিভাবে দ্রুত চিকিৎসা নিবেন তা নিয়ে ভাবনার শেষ নেই খালেদার।

এমন পরিস্থিতি দেখে টেলিমেডিসিনের পরামর্শ নিতে বলেন তাঁর সহকর্মী রোকসানা। মুঠোফোনে  বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে কথা বলে তাঁর যাবতীয় সমস্যার কথা জানালে তিনি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরামর্শ দেন । নিয়মিত  ডাক্তারদের স্বাস্থ্য পরামর্শ ও ফলোআপ চিকিৎসা নিয়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেন খালেদা । ঘরে বসে এধরনের সেবা পেয়ে টেলিমেডিসিনের উপর তাঁর আস্থা তৈরি হয়।

অন্যদিকে পঞ্চাশোর্ধ রাবেয়া বেগম দুই মেয়ে নিয়ে টাঙ্গাইলে থাকেন। দুই বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। কয়েক দিন ধরে অসুস্থতা অনুভব করেছেন। বাড়ির পাশের ফার্মেসীতে গিয়ে ফার্মাসিস্টকে দেখালে তিনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে বলেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে যাতায়ত, ডাক্তারের পরামর্শ ফি ও ওষুধ কিনতে অনেক টাকা লাগবে, যা রাবেয়ার সামর্থ্যের বাইরে। এদিকে মায়ের চিকিৎসা নিয়ে বেশ চিন্তিত রাবেয়ার কলেজ পড়ুয়া মেয়ে তানহা। বিষয়টা তাঁর বান্ধবীকে সে জানালে টেলিমেডিসিন সেবা নেওয়ার পরামর্শ দেন।

পরামর্শ অনুযায়ী সরকারি হেল্পলাইন ’৩৩৩’ নাম্বারে ফোন দেয় তানহা। প্রথম কলেই হটলাইনে একজন মহিলা ডাক্তারের সাথে সংযোগ পেলেন। তাঁর মায়ের শারীরিক অবস্থা বর্ণনা করলে ডাক্তার শুনেন ও কিছু প্রশ্ন করেন। তারপর কয়েকটি ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেন ডাক্তার। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন ও অন্যান্য নিয়ম মেনে ৬ দিনেই সুস্থ হয়ে উঠেন রাবেয়া বেগম। সুস্থ হওয়ায় পর তাঁর  প্রতিবেশীদের টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণ করতে বলেন।

খালেদা ও রাবেয়ার মতো প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার মানুষ ঘরে বসে টেলিমেডিসিন সেবার সুযোগ করে দিয়েছে বর্তমান সরকার, তা বলাই বাহুল্য। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে তথ্যপ্রযুক্তি   খাতকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।

টেলিমেডিসিন কি?

Telemedicine (টেলিমেডিসিন) শব্দটি tele এবং‎ medicine শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। কোনো ভৌগোলিক দূরত্বে অবস্থানরত রোগীকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সাহায্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বিশেষায়িত নেটওয়ার্ক ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্র, ইত্যাদির সমন্বয়ে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়াকে টেলিমেডিসিন বলা হয়। টেলিমেডিসিন সেবা telehealth, telecare এবং e-medicine নামেও পরিচিত।

টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের রোগীরা ঘরে বসে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ নিতে পারেন। চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায় টেলিফোন, মোবাইল, ভিডিও কনফারেন্স বা অনলাইনের বিভিন্ন কলিং সফটওয়্যার যেমন- হোয়াটসআপ, ভাইবার, ইমো ইত্যাদি।

বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন সেবাঃ

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও মুঠোফোন চিকিৎসা সেবা বা টেলিমেডিসিন সেবা চালু হয়েছে। দেশে টেলিমেডিসিনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৯ সালে Swinfen Charitable Trust এর হাত ধরে। তখন ক্যামেরা ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় ছবি তুলে ইমেইলের মাধ্যমে কনসালট্যান্টের কাছে পাঠানো হতো।  এরপর থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানাভাবে টেলিমেডিসিন সেবা চলমান রাখে। যদিও বাংলাদেশের মানুষ এ সেবার সাথে ওইভাবে পরিচিত হয়ে উঠেনি। মুঠোফোন সহজলভ্য হওয়ার পর থেকে মানুষ রোগব্যাধিতে পরামর্শ পাওয়ার পাশাপাশি ক্ষুদে  বার্তায় ব্যবস্থাপত্র পেতে শুরু করেন।

এদিকে করোনাকালে মানুষের প্রধান সহায় হয়ে উঠেছে টেলিমেডিসিন। করোনা মহামারীর সময় চিকিৎসক ও রোগীর মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সংক্রমণভীতি। হাসপাতাল বা চিকিৎসকের চেম্বারে ঝুঁকি বেশি-এই বিবেচনায় রোগীরা এসব স্থানে এড়িয়ে চলতেন। তাছাড়া অনেক ডাক্তার সরাসরি রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছিল সেসময়। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারির সময় চিকিৎসার সেরা বিকল্প টেলিমেডিসিন। করোনা রোগীরা হাসপাতালের চেয়ে বেশি সেবা পেয়েছেন এই বিকল্প পন্থায়। করোনা ছড়িয়ে পড়া রোধে এটা একটি সফল মাধ্যম। একই সঙ্গে এটা শুধু বর্তমানই নয়; ভবিষ্যতেও এর চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে।

টেলিমেডিসিন সেবায় সরকারের যত উদ্যোগঃ

ডিজিটাল বাংলাদেশে নাগরিকের আধুনিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। সহজলভ্য ও দূরবর্তী  চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে সরকার টেলিমেডিসিন সেবা চালু করেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সরকারি হেলথ কল সেন্টার: স্বাস্থ্য বাতায়ন ‘১৬২৬৩’  এবং আইসিটি মন্ত্রনালয়ের এটআুই প্রোগ্রাম দ্বারা পরিচালিত জাতীয় হেল্পলাইন ‘৩৩৩’।

সরকারি হেলথ কল সেন্টার: স্বাস্থ্য বাতায়ন ‘১৬২৬৩’ঃ

২০১৬ সালে সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চালু করে ‘সরকারি হেলথ কল সেন্টার: স্বাস্থ্য বাতায়ন’। এ সেবা পেতে ‘১৬২৬৩’ নম্বরে ডায়াল করলেই ২৪ ঘণ্টা বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবার পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।এছাড়া স্বাস্থ্য বাতায়ন দেশের যেকোনো স্থানের রোগীদের প্রয়োজনে নিকটবর্তী সরকারি-বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবা পেতেও সহায়তা করছে।

২০২০ সালে করোনার কারণে যখন স্বাস্থ্য অবকাঠামো ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল তখন মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩ একটি অভিনব সেবা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।  অন্যান্য সেবা যখন মিলছিল না, তখনও অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়ার সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম স্বাস্থ্য বাতায়ন সবসময় খোলা ছিল। সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে যাদের কোভিড-১৯ সংক্রমণ ধরা পড়েছে, পরবর্তীতে হেল্পলাইন থেকে ফোন করেও খোঁজখবর নেওয়া হয়, পরামর্শ সেবা দেওয়া হয়। এই হেল্পলাইনে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ কোটি ৯৭ লাখ মানুষকে মুঠোফোনে সেবা দিয়েছে সরকার।

জাতীয় হেল্পলাইন ‘৩৩৩’ঃ

২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি মন্ত্রনালয়ের এটআুই প্রোগ্রাম দ্বারা চালু করে জাতীয় হেল্পলাইন ’৩৩৩’ যা ‘জাতীয় হেল্পলাইন’ নামেও পরিচিত।  এর মূল লক্ষ্য বাংলাদেশের নাগরিকগণ যেন জাতীয় তথ্য বাতায়নের সকল তথ্য ও সেবা পেতে পারেন।  দেশের নাগরিকরা ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সেবা পেতে ১ চেপে মেন্যুতে প্রবেশ করে ঘরে বসেই নিরাপদে অভিজ্ঞ ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারছেন। শুধুমাত্র তালিকাভুক্ত চিকিৎসকরাই এখানে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। করোনাকালে হেল্পলাইনে ফোনের সংখ্যা অনেক বেড়েছে বলে আইসিটি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

এছাড়া ৩৩৩ নম্বরের মাধ্যমে জেলা প্রশাসক  ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ মাঠ পর্যায়ের সকল কর্মকর্তার নিকট বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধান ও নাগরিক সেবা প্রাপ্তির বিষয়ে অনুরোধ করতে পারেন। এই সেবা চালু হওয়ার পর থেকে মোট ৭ কোটি ৬০ লক্ষেরও অধিক কল গৃহীত হয়েছে, যার মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় ২৬ হাজারের অধিক সামাজিক সমস্যার সমাধান করা হয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হটলাইন ১০৬৫৬ঃ

২০১৪ সাল থেকে টেলিমেডিসিন সেবা দিয়ে আসছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতাল সূত্রে জানাগেছে, ২০ থেকে ২৫টি উপজেলা তাদের সাথে সংযুক্ত রয়েছে, যারা নিয়মিত অনলাইনে সেবা নিচ্ছেন। কবে কোন ডাক্তার থাকবেন, সেসব তাদের জানা আছে। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ২০২০ সালে টেলিমেডিসিনের হটলাইন ‘১০৬৫৬‘ সেবা চালু করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নম্বরটিতে ২৪ ঘণ্টা টেলিমেডিসিন সেবা পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া প্রত্যেকটি বিভাগে আলাদা নম্বরে ফোন করে রোগীরা সেবা নিতে পারবেন। নাম্বারগুলো হচ্ছে- মেডিসিন বিভাগ ০১৭৯৭১৭০১৩৯, ০১৭৯৭১৭০৮৬৫;সার্জারি বিভাগ ০১৭৯৭১৭৮৪৩৫; গাইনি বিভাগ ০১৭৯৭১৭১০১৮; শিশু বিভাগ ০১৭৯৭১৭০২৯৪; জরুরি বিভাগ ০১৭৯৭১৭০৩৫৮; কার্ডিওলজি বিভাগ ০১৭৯৭১৭৪৮১৭ ও প্রশাসন বিভাগ ০১৭৯৭১৭১৩৫৬ নম্বরে ফোন করেও টেলিমেডিসিন সেবা মিলছে।

এছাড়া সরকারি সকল হাসপাতাল, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাল থেকে  টেলিমিডিসিনসেবা দেওয়া হচ্ছে। যার ফলে সমগ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ ঘরে বসেই সঠিক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরামর্শ পাচ্ছেন।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে টেলিমেডিসিনের প্রচলন বাংলাদেশের জন্য নতুন ও আধুনিক একটি ধারণা। প্রযুক্তি ব্যবহার করে অসুস্থ রোগীরা এখন গ্রামে বসেই রাজধানীর বড় বড় ডাক্তারদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারছেন। হাজার হাজার টাকা খরচ করে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসতে হচ্ছে না।

প্রয়োজনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চিকিৎসকের সঙ্গে রোগী কথা বলতে পারছেন, সমস্যাগুলো দেখাতেও পারছেন। পুরনো রোগীরা তাদের প্রেসক্রিপশন হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবারে পাঠিয়ে দিয়ে বিশেষজ্ঞের নতুন পরামর্শও নিতে পারছেন, পুরো বিষয়টা আমাদের জন্য আশির্বাদ স্বরূপ।

বেসিস (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস) সূত্রে জানা গেছে, দেশে টেলিমেডিসিনের বাজার প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার।  প্রতিদিন ২০ হাজারের বেশি রোগী টেলিমেডিসিন সেবা নিচ্ছেন। দেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠীর টেলিমেডিসিন সেবায় অভ্যস্ত হতে হয়তো আরও কয়েক বছর লেগে যাবে। তবে এটা নিশ্চিন্তে বলা যায়, টেলিমেডিসিন সেবা খুব শীঘ্রই স্বাস্থ্য সেবার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে।

লেখকঃ সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও সংবাদ

সম্পাদক ও প্রকাশক: মুহাম্মদ আমীরুল হক পারভেজ চৌধুরী

সম্পাদকীয় কার্যালয়ঃ
এডুএইড ৪র্থ তলা ৭৮ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা ১০০০
ইমেইল : eduaid21@gmail.com

© কপিরাইট এডুএইড ২০২৪।   ওয়েবসাইট নির্মানেঃ Contriver IT

সর্বশেষঃ