এ.ভি.ডাইসি বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই আজ তার ‘আইনের শাসন’ তত্বটি হয়তো ফেরত চাইতেন। কারন তিনি বুঝতে পারেননি যে কিছু মানুষ আইনের উর্ধে চলে যাবেন, তিনি বুঝতে পারেননি যে আইনের চোখে সবাই সমান হবেন না। লিগ্যাল সিস্টেমের দেশে একটা দেশ পরিচালিত হয় লিগ্যাল সিস্টেম তথা আইন অনুযায়ী আর দেশের লিগ্যাল সিস্টেম এ সুনির্দিষ্ট আইনের বালাই নেই, যখন মানুষ যা মন চাই তাই করে। ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন দেশের সংবিধানে ‘আইনের শাসন’ নামক তত্ত্বটি সুন্দরভাবে স্থান পেয়েছিল। কিন্তু বাস্থবায়িত হতে পারেনি কোনদিন। বিশ্বের উন্নত দেশের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তারা লিগ্যাল সিস্টেমের আওতাধীন এবং দেশও তদনুসারে চলে। দুর্ভাগ্য যে আমাদের লিগ্যাল সিস্টেম রয়েছে, তবে সে অনুযায়ী চলতে পারিনি।
পরপর দু’টো বড় ঘটনা আজ দেশের মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। দু’টোতে ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। ফোনালাপ ফাঁস দিন দিন একটা সংস্কৃতিতে পরিনত হচ্ছে। আর দেশের সাধারণ মানুষ তার নিজ অবস্থান থেকে সাব জুডিস ম্যাটার নিয়ে বিশ্লেষণ করে যাচ্ছেন। যদিও ফোনালাপ ফাঁস হতে পারে কেবলমাত্র তদন্তের স্বার্থে, মামলার প্রয়োজনে এবং তা গোপন থাকবে। একজন স্ত্রী নিয়ে রিসোর্টে গিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগকারী ছাড়াই তাকে নিয়ে দেশের মানুষের অনেক ভাবনা আমরা দেখেছি। অতঃপর গ্রেফতার ও পরবর্তীতে মোবাইল চুরির মামলা দেয়া হয়, যা এখনো তদন্তাধীন। অপরদিকে বড় লোকের আদরের ঘরের দুলালের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট গুরুতর অভিযোগ ও মামলা হয়েও দেশ ত্যাগের সুযোগ পায় অথবা পুলিশের অন্তরালে থাকার সুযোগ হয়। আসলে কিছু মানুষ সত্যিই আইনের উর্ধে আর আইনের উর্ধে থাকার জন্যই হয়তো কষ্ট করে শীর্ষ ধনী হবার চেষ্টা করেন তারা।
যাহোক, অপরাধ প্রবনতা মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তি। পৃথিবীর শুরু থেকে ধ্বংস অবধি মানুষের এই প্রবৃত্তি থাকবে, শয়তানের অস্তিত্ব ও কাজের সুযোগ থাকবে। মানুষ অপরাধ করলে একটা সভ্য দেশে তার নিজস্ব আইনে বিচারের ব্যবস্থা থাকবে বৈষম্যহীনভাবে। মামলা ফাইল হবার পর থেকে পুলিশ তার স্বাভাবিক গতিতে তদন্ত করবেন এবং প্রতিবেদন জমা দিলে আদালত তার প্রক্রিয়া অনুসরণ করে রায় দিবেন। সাধারণ মানুষ নাক না গলানো তার কাজ। কিন্তু আজ দেশের মানুষের উদ্বেগ দেখে সহজে অনুমেয় যে ন্যয়বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে হয়তো সবাই ট্রল করছেন। আমাদের এই ফোনালাপ ফাঁস ও সাব জুডিস ম্যাটার নিয়ে ট্রল করার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে আইন আদালত তথা লিগ্যাল সিস্টেম তার ভাবগাম্ভীর্যতা হারাবে, তখন দিনে দিনে এই দেশ অসভ্য রাষ্ট্রে পরিনত হবে। অপরাধী অপরাধ করলে বিচার কার্যে নিয়ম স্বরুপ জামিন চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই নিয়েও ট্রল হচ্ছে। অনেকে কারণ হিসাবে লিখছেন আগাম জামিন যদি বন্ধ থাকে, তবে এখন কেনো। সর্বোপরি দেশের এমন অবস্থায় তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে এতো আলোচনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, আদালতের এ বিষয়ে হস্তক্ষেেপের দরকার রয়েছে।
ইতোমধ্যে আমরা জানতে পেরেছি যে, মুনিয়ার অপমৃত্যুতে একটা আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা হয়েছে। জনমনে প্রশ্ন, যে মৃত্যু নিয়ে কোনো ঘটনায় কারো জানা নাই, তদন্তের আগে থানা কিভাবে নিশ্চিত হলো যে এখানে হত্যা হয়নি, আত্মহত্যার প্ররোচনা হয়েছে। আবার ওসি সাহেব নাকি নিজেই তদন্ত করবেন। কেনো তার কি তদন্ত টিম নেই? অনেকে আবার লাইভে এসে বলে যাচ্ছেন মুনিয়া কে আইনগত সহায়তা দিবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। যে মুনিয়া জীবদ্দশায় একজন কে বিশ্বাস করে জীবন হারালো, মৃত্যুর পর আপনাদের বিশ্বাস করে আবারো ন্যায় বিচার পাবে, এই নিশ্চয়তা কে দিবে তাকে? আসলে বড়ো মামলার ধান্দাটা অনেক বড়ো হয়, তাই হয়তো সবাই আগ বাড়িয়ে দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসছেন।
অপরদিকে মুনিয়াদেরও অনেক ভাবার বিষয় রয়েছে, এতো বড়ো প্রোফাইল তার সাথে যায়না, এক লক্ষ টাকার বাসা ভাড়া! ইত্যাদি। নামাজ, তাহাজ্জুদ পড়া মেয়ে কি তার কৃতকর্ম বুঝে নি? ঘটনা ঘটে যাবার পর যারা নিজ বোনের পক্ষে সাফাই গাইলেন, জীবিত থাকতে কেনো বোনকে বারন করলেন না, কেনো তার উচ্চবিলাসী জীবনকে স্বাভাবিক ভাবলেন। এক মুনিয়ার মৃত্যু হলেও হাজারো মুনিয়ার বসবাস এই শহরে। অভিভাবকরা আগে থেকেই খোঁজ রাখবেন। মরে গেলে কে মুক্তিযুদ্ধ ছিলেন আর কে কোটিপতি ছিলেন, এগুলো হাস্যকর। এ সোনার বাংলা তার নিজস্ব লিগ্যাল সিস্টেমে পরিচালিত হউক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কাহিনী নিয়ে নয়, এই হউক আমাদের সকলের আগামীর ভাবনা এবং লিগ্যাল সিস্টেম তার আপন গতি পাক দেশ ও দশের ন্যায় বিচারের স্বার্থে।
লেখকঃ সাজজাদুল ইসলাম রিপন, এডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।