নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা উড়ে যাচ্ছে। সূর্যের ঊষ্ণতা ধিরে ধিরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেলকুনির একপাশে কিছু ফুল গাছ আর একটা পাখির খাচা তার মধ্যে একটা ময়না পাখি।
সকাল নয়টা বাজে বেলকুনিতে বসে আছে আকাশ। হাতে হুমায়ুন আহমেদের লিখা বই “অপেক্ষা”। কভার পেইজে চোখ বুলিয়ে পাতা উল্টাবে, হঠাৎ কিচিরমিচির শব্দ ভেসে এলো তার কানে। চোখ তুলে তাকালো বাইরে। পাঁচতলা বাড়ির তিনতলার বেলকুনি থেকে স্কুলটা দেখা যাচ্ছে। স্বপ্নকুঁড়ি কেজি স্কুল। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। অনেক গুলা বাচ্চা মাঠে খেলতেছে। দৌড়াদৌড়ি করতেছে, হাসতেছে মাঠে ধুলা উড়তেছে। চোখের চশমাটা নামিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশ। হারিয়ে গেল সে তার ভাবনার জগতে।
সালটা ২০০৮। পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ে আকাশ। ক্লাস রুমের সামনে তার ক্লাসমেট সাদিয়া, মীম, ফারিহা, অনিক কুতকুত খেলতেছে। ছোট ছোট অনেকগুলা বাচ্চা দৌড়াচ্ছে, খেলতেছে। দপ্তরী ঘন্টা বাজালো ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। সবাই খেলা বন্ধ করে দ্রুত ক্লাসে ঢুকে পড়লো। একটু পর স্যার প্রবেশ করলো। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। কেমন আছো সবাই? জি স্যার, ভাল। স্যার এসে প্রথমে হাজিরা ডাকছে– রোল ১, ইয়েস স্যার ২, ইয়েস স্যার, ৩, ৪, ৫, ৬……. ২০ প্রেজেন্স স্যার, একটা মেয়ে হাজিরা দিলো। এ্যাঁ স্যার ব্রু কুচকে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালো। সবাই হাসতেছে, এই চুপ! চুপ! কিপ সাইলেন্ট, সবাই চুপ হয়ে গেল। স্যার বাকি হাজিরা ডেকে খাতাটা টেবিলের উপর রাখলো।
এরপর স্যার বোর্ডে অংক করাচ্ছে। এমন সময় হেড মাস্টার স্যার প্রবেশ করলো উনার পিছনে পিছনে আরো দুইজন প্রবেশ করলো।
স্যার, ইনি কামাল সাহেব উনার মেয়েকে ভর্তি করেছেন। ও ফারিহা, আগে বিদ্যা নিকেতনে পড়তো এখন থেকে এখানে পড়বে। যাও মা বসো, হেড মাস্টার স্যার বললেন।
আসো, এই ওকে বসতে দাও, আলমগীর স্যার বললেন। আচ্ছা আসি স্যার। ওকে, আসসালামু আলাইকুম। স্যার আবার অংক করাচ্ছেন।
ফারিহা গোল চেহারার মিষ্টি মেয়ে, গায়ের রং ফর্সা, হাসলে মুখে টোল পড়ে।সাদা ধবধবে একটা জামা গায়ে দিয়ে এসেছে। মাথায় ঝুটির মতো সাদা স্কাফ।দেখতে পরীর মতো লাগছে। প্রথম দেখেই ক্লাসের সবাই হা হয়ে তাকিয়ে ছিল। মনে হচ্ছে, সত্যিই আসমানী সাদা পরী এসে দাঁড়ালো সবার সামনে।
অংক ক্লাশ শেষ। মেয়েদের অনেকেই তার সাথে পরিচিত হচ্ছে। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে ক্লাস রুম দেখতেছে। দুষ্টুরা একে অন্যকে কাগজ মারামারি করতেছে। এভাবেই ক্লাস চলতেছে। কিছুদিন পর প্রথম ক্লাস শেষ, হঠাৎ একটা কাগজ এসে পড়লো আকাশের ব্যাগের উপর। সে খুলে দেখলো, এই তোমার নাম কি? ইতি ভুত।
আকাশ তারপর মেয়েদের সারির দিকে তাকালো, দেখলো সব স্বাভাবিক। একটু পর আরেকটা কাগজ পড়লো তার শার্টের উপর। এই তোমার নাম কি সুন্দর ছেলে? ইতি “ফ” ভূত।
আকাশ তার বন্ধু রহিমকে দেখালো। দেখনা বন্ধু ঐদিক থেকে এটা এসেছে। বাহ বন্ধু, এতদিন এই স্কুলে পড়ি একটা কাগজ পেলাম না আর তুই প্রথম বছরেই, বাহ! তুইতো সালা ভাগ্যবান। আরে দূর ব্যাটা! একটু দেখিসতো কেউ এদিকে তাকায় কিনা। অনেকেই তাকাচ্ছে, নাহ, কাউকে আন্দাজ করা গেল না।
পরদিন আকাশ তাকিয়ে আছে মেয়েদের সারির দিকে, তাকে জানতে হবে কে এই ভূত!
নাহ, কেউ তো নেই! একটু পর আবার তাকালো। এইবার চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি চোখ মেরে দিলো। আকাশের বুকে ধড়পড় করতে লাগলো। একটু পর আবার তাকালো। আবার চোখ মেরে এবার মুচকি হাসছে।
আকাশ আর তাকায়না। একটুপর সে রহিমকে বললো, দোস্ত দেখ দেখ মেয়েটা কেমন আমার দিকে তাকিয়ে আছে আবার চোখ মারছে আমাকে!
ও আচ্ছা, দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।
আসলে আকাশ বুঝতোনা
এসবের মানে কি! কেনই বা মেয়েটি এমন করছে!
আবার চোখ মেরে এবার মুচকি হাসছে, আকাশের চোখ পড়তেই অন্যদিকে ফিরে তাকায়। সেদিনের মতো ক্লাস শেষ। সবাই ক্লাস থেকে বের হচ্ছে। হঠাৎ আকাশের ব্যাগে টান পড়লো। মনে হয়, কে যেন টেনে ধরেছে। ফিরে তাকাতেই মুচকি হাসি। আকাশ খুব লাজুক ছেলে সে দ্রুত চলে গেল তার রুমে। স্কুল হোষ্টেলে থাকতো সে। নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে কিন্ত আকাশ মেয়েদের সারির দিকে ভুলেও তাকায় না। তৃতীয় বিষয় পর একটা কাগজ এসে পড়লো আকাশের পায়ের কাছে। সে খুলে দেখলো, কি হলো এদিকে তাকাও, তাকাও বলছি!
সে ভয়ে ভয়ে তাকালো। ফারিহা চোখ মেরে মুচকি হাসছে। আকাশ রাগী চোখে তাকালো কিন্ত ফারিহা আবার হাসছে। দোস্ত মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে আমার এসব ভাল লাগেনা। আচ্ছা দেখাচ্ছি মজা, রহিম বললো। একটু পর ফারিহা তাকাতেই রহিম তার পায়ের জুতা খুলে, এই জুতা দেখেছিস! আরেকবার এমন করলে জুতা খুলে মারবো।
ফারিহা হতভম্ভ হয়ে গেছে। সে টেবিলের উপর মুখ রেখে দুহাতে মুখ লুকিয়ে কান্না করছে। এই এমনটি করা ঠিক হলো! আকাশ রহিমকে বললো। আরে এগুলারে এমন করে শায়েস্তা করা দরকার।
এরপর আকাশ অনেক্ষণ তাকিয়ে ছিলো একটিবারও আর তাকায়নি।
ফারিহার কান্না দেখে আকাশ খুব কষ্ট পেয়েছে। চোখ মেরেছে তাই বলে এইভাবে একটা মেয়েকে অপমান করা! সে রহিমকে অনেক বকেছিল, আসলে আকাশ কারো কষ্ট সইতে পারেনা। প্রতিদিন আকাশ একটু পরপর তাকায় শুধু একটি বার সরি বলার জন্য। কিন্ত ফারিহা রাগে অভিমানে একবারও তাকায় না। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে একদিন ভেজা কোঁকড়ানো এলোমেলো চুল নিয়ে ক্লাসে ডুকলো আকাশ, সবাই তাকে দেখে হাসতেছে। তার চোখ সবার চোখ ভেদ করে ফারিহার দিকে। চোখে চশমা ফারিহার। সে মুচকি হাসছে। আকাশ তাকাতেই হাসি বন্ধ করে মুখ ফেকাসে করে তাকিয়ে আছে। আকাশ মুচকি হাসছে। সেও হাসি দিল।
এভাবে সময়গুলা পার হয়ে যাচ্ছে। আকাশ এমনিতেই মেয়েদের থেকে দুরে থাকে। কথাও কম বলে। মেয়েরা কথা বলতে চাইলে লজ্জায় আমতা আমতা করে বলতো…
একদিন স্যার আসতে দেরি হচ্ছে মেয়েগুলা ক্লাসের দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে আকাশ ডুকতে চাচ্ছে কিন্ত তারা দিচ্ছেনা। দুইটা মেয়ে হাত বাড়িয়ে দরজা ধরে আছে যেতে দিবেনা।আকাশ লাজুক হলেও একটু বদমেজাজি রাগী টাইপের। সে হাত গুলোকে ধাক্কা মেরে ডুকে গেল। সাদিয়া এসে বললো… কিরে তুই এমন করলি কেন? আকাশ কিছু না বলে চুপ করে বসে আছে। সাদিয়া অনেকগুলা কথা শুনিয়ে চলে গেল। আকাশ কিচ্ছু বললো না। আজ তাদের দ্বিতীয় সাময়িক পরিক্ষার রেজাল্ট দিবে। আকাশ ৪৬ থেকে ০৬ এ আসছে। সময়গুলা যে যার মতো করে পার করে দিচ্ছে।কেউ কারো সাথে কথা নেই এসবের আর কোন খবরই নেই।আকাশ ছেলেদের সাথেই খেলাধুলা ও আড্ডা নিয়ে থাকতো। এভাবে একদিন পঞ্চম শ্রেনীর সমাপনী পরীক্ষা দিয়ে সবাই পাশ করে চলে গেল। এরপর ফারিহার সাথে আকাশের আর কখনো দেখা হয়নি।
হঠাৎ ঘন্টার শব্দ, আকাশ চমকে উঠলো, বাচ্চাগুলো মাঠ ছেড়ে দৌড়ে ক্লাসে ঢুকে যাচ্ছে। সে তাকিয়ে আছে আর মুচকি হাসছে। সবই ভাবনা!
পিছন থেকে কে যেন বলছে
কিরে তুই এখানে! আর আমি তোকে খুঁজে মরি, এই নে ধর তোর চা। কল্পনা বললো।
লিকার ঠিক আছে তো! খেয়ে দেখ তো, আমাকে খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে কেন মহারানী!
কেন! তোকে বুঝি খোঁজাও যাবেনা! দেখাও যাবেনা!
দেখা, চোখাচোখি আর কতো! জীবনের শুরুটাইতো এভাবেই কেটে গেল, মানে! কি বলছিস, আমিতো কিছুই বুঝছিনা।
তোর আর বুঝা লাগবেনা। এই নে কাপ, বিদায় হ এখন। এই তুই আমার সাথে এমন করিস কেন? একটু সুন্দর করে কথা বলতে পারিস না! কথাগুলো বলেই কল্পনা রাগ মুডে ভেংচি কেটে চলে গেল। আকাশ ও কল্পনার মধ্যে কথা হচ্ছে। কল্পনা আকাশের খালাতো বোন। বেড়াতে এসেছে। আকাশ জানে কল্পনা যে তাকে পছন্দ করে কিন্ত কি আর করা! সারাদিন ওদের খুনশুটি আর ঝগড়াতেই দিন কেটে যায়।
আজ হঠাৎ ফারিহাকে মনে পড়ে গেল।শেষ দেখা হয়েছিল ২০১৫ সালে। যখন আকাশ কলেজে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।
আকাশ বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে মুজিব কলেজের লাইব্রেরি গেটে। একটা মেয়ে এগিয়ে আসছে কলা ভবনের সামনে থেকে। কফি কালারের বোরকা পরা, চোখে চশমা, বাম কাঁধে একটা কালো ব্যাগ ঝুলানো। আকাশ তাকিয়ে আছে দেখতে ঠিক ফারিহার মতো। কাছে আসতেই, হ্যা! এতো ফারিহাই! ভাবছে ডাকবে কিনা, নাহ, সে তাকিয়ে আছে তার চোখের আড়াল হওয়া পর্যন্ত।
ওটাই ছিল শেষ দেখা আর কখনো দেখা হয়নি। এখন ২০২০ সাল!
বইটা রেলিংএর উপর রেখে চেয়ার থেকে উঠে দেয়ালের এক পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, কি ছিলো সেই চোখ মারায়! মুচকি হাসি! শুধুই কি চোখাচোখি আর হাসি নাকি অন্য কিছু!
এখন যে তাকে মনে পড়ে! এটাকি ভালোবাসা! আবেগ! মায়া! নাকি কল্পনা!
আচ্ছা, সে এখন কেমন আছে? সে কি ভাবছে আমাকে! ভাবার তো কথাই না, মনে থাকলেতো! সে এখন স্বামীর সংসারে। হয়তো দুই-তিন বাচ্চার মা হয়ে গেছে।
আচ্ছা! এতো বছর পরও কেন তাকে মনে পড়ে? ইসস, তখন যদি বুঝতাম এভাবে হারিয়ে যেতে দিতাম না। আকাশ ভাবনায় ডুবে আছে। দিনের আলোয় সাদা পরীর মতো কে যেন দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। চোখে চশমা, মুখে মৃদু হাসি, দু’হাত বাড়িয়ে খিলখিল হাসির শব্দ। সামনে পা বাড়াতেই হাওয়ায় মিশে গেল। আকাশ ডাকছে, ফা… ফা…ফারিহা…. এ যেন আকাশ কুসুম কল্পনা।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখ পড়লো বইয়ের উপর। আরে বইটা তো পড়াই হলো না। আকাশ বইটা হাতে নিয়ে চোখে চশমা লাগিয়ে কভার পেইজ দেখছে আর মৃদু হাসছে, তাতে লিখা- অপেক্ষা।
আকাশ বইটা পড়া শুরু করলো……
লেখকঃ তাহছিন আহমেদ, মানবাধিকার কর্মী।
শিক্ষার্থীঃ কবি নজরল সরকারি কলেজ, ঢাকা।