ইনডেমনিটি,এক কালো আইনের কথা

দুলাল আচার্য

জাতির পিতার খুনিদের দায়মুক্তি দিতে তৎকালীন দখলদার রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মানবতাবিরোধী কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। মানবতার ইতিহাসে এটি কালো আইন (ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ) হিসেবে  চিহ্নিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে এ আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এই দায়মুক্তি আইন প্রণয়ন করেছিল খুনিদের প্রধান খলনায়ক খন্দকার মোশতাক আহমেদ। অর্থাৎ, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা হলে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আইনি ব্যবস্থা  থেকে শাস্তি এড়ানোর জন্য এ আইন করা হয়েছিল। তখন বাংলাদেশে সংসদ অধিবেশন না থাকায় আওয়ামী লীগের একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী হয়েও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে মোশতাক আহমেদ অধ্যাদেশ আকারে ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সালে এ আইন প্রণয়ন করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরে খন্দকার মোশতাকই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করে। আইনটি ১৯৭৫ সালের ৫০ নম্বর অধ্যাদেশ হিসেবে অভিহিত ছিল। ১৯৭৯ সালে আইনটি সংসদ কর্তৃক অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার আইনটি বাতিল করেন, যার ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারের পথ আবার খুলে যায়। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ হাইকোর্ট সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে। উল্লেখ্য, এটি ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নং ৫০ নামে অভিহিত ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চারবছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেয়া হয়। সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিলো সংবিধান (সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯। এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত হয়েছিলো, যা পঞ্চদশ সংশোধনীতে বিলুপ্ত হয়। পঞ্চম সংশোধনীকে বৈধতা না দিলে জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যেত কিন্তু জিয়াউর রহমান তা করেনি। মূলত, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে রূপান্তর করে জেনারেল জিয়া প্রমাণ করেছেন তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রক্ষাকারী এবং এই হত্যার ষড়যন্ত্রের মূল কুশিলবদেরই একজন।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশে ‘দ্য বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষর রয়েছে। মোশতাকের স্বাক্ষরের পর অধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান পঞ্চম সংশোধনী বিলটি পেশ করে। শাহ আজিজ রাজাকারদের অন্যতম। অধ্যাদেশটিতে দুটি অংশ আছে প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট  ভোরে বলবত আইনের পরিপন্থি যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবে, তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো, অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। সংবিধানের গণতন্ত্র বিষয়টা খর্ব হবে বলে অনেকে বিরোধিতা করলেও রাষ্ট্রপতি একক ক্ষমতাবলে সংশোধনী বিল পাশ করান। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে মোট তিনবার ইনডেমনিটি আইন পাশ করা হয়। ২০১০ সালে এসব অধ্যাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এ ইনডেমনিটি ছিল এমন একটি আইনÑ যা ইতিহাসে লজ্জাজনক।

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বা রহিত করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনিরা হত্যার কথা প্রকাশ্যে বলে বেড়াত। এরশাদ ক্ষমতায় আসীন হলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল না করে আবার নিজের সুবিধার জন্য দ্বিতীয়বার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন যা ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় এবং সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীতে এটি অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত এরশাদ সরকারের জারিকৃত সকল প্রকার সামরিক আইন, অধ্যাদেশ, বিধি নির্দেশ ইত্যাদি  বৈধতাদানের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। পরে বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের সময় ২৩  ফেব্রুয়ারি ২০০৩ যৌথ অভিযান দায়মুক্তি বিল ২০০৩ নামে সর্বশেষ ইনডেমনিটি আইন পাস হয়। জিয়া, বিচারপতি সাত্তার, জেনারেল এরশাদ এবং খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকলেও কোনো সরকারই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেনি। বরং খুনীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। সামরিক  স্বৈরাচারের ভোট খেলায় খুনিদের এমপিও বানানো হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু ছাড়াও আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, বেনজির ভুট্টো, বন্দরনায়েককে হত্যা করা হলেও সেসব দেশে ইনডেমনিটি আইন জারি করা হয়নি, কিন্তু বাংলাদেশে এমনটি করা হয়েছিল। সংবিধান মানুষের অধিকার রক্ষাকবচ। পৃথিবীর কোনো সংবিধানে লেখা নেই যে খুনিদের বিচার করা যাবে না। বাংলাদেশেই প্রথম ঘটেছিল, এমনকি বঙ্গবন্ধুর হত্যার ২০ বছর পার হলেও কোনো রাষ্ট্রপতি বা সরকারপ্রধান সেটি বাতিল না করে উলটো নিজেদের সুবিধা নেওয়ার জন্য ইনডেমনিটি বহাল রাখে। আমাদের জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা বাঙালিকে সেই কলঙ্কমুক্ত করেছেন।

পঞ্চম সংশোধনীকে বৈধতা না দিলে জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যেত। কিন্তু জিয়াউর রহমান তা করেনি। মূলত, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে রূপান্তর করে জিয়া প্রমাণ করেছেন তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রক্ষাকারী এবং এই হত্যার ষড়যন্ত্রের মূল কুশিলবদেরই একজন তিনি। কারণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর লাভবান কারা হয়েছে? এগুলো বিশ্লেষণ করলে জিয়াউর রহমান এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত ছিল।

কুখ্যাত এই অধ্যাদেশে দীর্ঘ ২১ বছর দৃশ্যত থমকে ছিল আইনের শাসন। পরে সুপ্রিম  কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের আইনকে বৈধ বলে রায় দেয়। এরই পথ ধরেই দায়ের করা হয় মামলা। আইনের আওতায় আনা হয় খুনিদের। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ। ইতিহাসের নৃশংস এ কালো অধ্যায়ের নেপথ্যে ছিলেন যারা, তাদের বিচার শুরু হতেও অপেক্ষা করতে হয়েছে ৩৪টি বছর। তবে দন্ডপ্রাপ্তদের কয়েকজন এখনো পলাতক। সর্বশেষ ২০২০ সালে আত্মস্বীকৃত খুনি ও মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরআগে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে ফাঁসি কার্যকর হয় ৫ খুনির।  একথা সত্য যে, ইনডেমনিটির বিষয়টা এখনও অনেকের কাছে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। অনেকের কাছেই এখনো অজানা ইতিহাসের এই কালো  অধ্যায়টি। তাই ইতিহাসটি নতুন করে বলা প্রয়োজন। জাতির পিতার খুনিদের মধ্যে এখনও পলাতক রয়েছেÑখন্দকার আবদুর রশিদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খান। বঙ্গবন্ধুর এই পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের ভয়াল দিনের কথা শেষ করা জরুরী। বঙ্গবন্ধুর এই পলাতক খুনিদের রায় কার্যকর করা এখনও জাতির কাছে দায়।

সেই দায় থেকে মুক্ত হওয়া সময়ের দাবি। বিশেষ করে অন্তবালের খুনিদের। দাবি উঠেছে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়াসহ কারা, কীভাবে জড়িত ছিলেন তা বের করা। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় জিয়ার যুক্ত থাকার বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে না আসায়  বিএনপি এখনও বড় গলায় কথা বলতে পারছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির জনক জিয়াউর রহমানের সমর্থকরা দেশে বিচার নেই বলে গলা আউরাচ্ছে। মনে রাখা প্রয়োজন, শেখ হাসিনা ছাড়া আর কারো পক্ষে জিয়ার মুখোশ উন্মোচনের কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তাই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই উদ্যোগ তাঁকেই নিতে হবে। ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে দেশে যে কালো অধ্যায়ের সূচনা করা হয়েছিল তেমন দিন যেন আর ফিরে আসে না এই প্রত্যাশাই হোক সবার।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও সংবাদ

সম্পাদক ও প্রকাশক: মুহাম্মদ আমীরুল হক পারভেজ চৌধুরী

সম্পাদকীয় কার্যালয়ঃ
এডুএইড ৪র্থ তলা ৭৮ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা ১০০০
ইমেইল : eduaid21@gmail.com

© কপিরাইট এডুএইড ২০২৪।   ওয়েবসাইট নির্মানেঃ Contriver IT

সর্বশেষঃ